৬. ৩. কুরআন-সুন্নাহর আলোকে ইফতিরাক - ৬. ৩. ১. পূর্ববর্তী উম্মাতদের মধ্যে ইফতিরাক

কুরআন কারীম ও হাদীস শরীফ থেকে আমরা জানতে পারি যে, যুগে যুগে আসমানী হেদায়াত প্রাপ্ত বিভিন্ন জাতি ও সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভিন্ন কারণে দলাদলি ও বিভক্তি দেখা দিয়েছে। হাদীস শরীফে রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাঁর উম্মাতের মধ্যেও বিভক্তি ও দলাদলি দেখা দেবে বলে জানিয়েছেন। এ সকল আয়াত ও হাদীস থেকে জানা যায় যে, বিভক্তি ও দলাদলির মূল কারণ ছিল ওহীর শিক্ষার ব্যতিক্রম করা বা ওহীর কিছু শিক্ষা ভুলে যাওয়া, ব্যক্তিগত বিদ্বেষ, হিংসা ইত্যাদির বশবর্তী হওয়া, ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দের উপর নির্ভর করা, অতিভক্তি, পূর্ববর্তী গুরুদের অন্ধভক্তি ও অনুকরণ ইত্যাদি।

ইহূদী-খৃস্টানদের বিভক্তি ও দলাদলি সম্পর্কে মহান আল্লাহ বলেন:

وَمِنَ الَّذِينَ قَالُوا إِنَّا نَصَارَى أَخَذْنَا مِيثَاقَهُمْ فَنَسُوا حَظًّا مِمَّا ذُكِّرُوا بِهِ فَأَغْرَيْنَا بَيْنَهُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ وَسَوْفَ يُنَبِّئُهُمُ اللَّهُ بِمَا كَانُوا يَصْنَعُونَ

‘‘যারা বলে ‘আমরা খৃস্টান’ তাদেরও অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলাম; কিন্তু তাদেরকে যা শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল তার এক অংশ তার ভুলে গিয়েছে। সুতরাং আমি কিয়ামত পর্যন্ত তাদের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ জাগরূক রেখেছি। তারা যা করত আল্লাহ তাদেরকে তা জানিয়ে দিবেন।’’[1]

এ আয়াতে আমরা দেখছি যে, খৃস্টানদের বিভক্তির মূল কারণ ছিল তাদেরকে যা শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল বা তাদের উপর নাযিলকৃত ওহীর কিছু অংশ ভুলে যাওয়া। আমরা দেখেছি যে, তাদের এ ভুলে যাওয়ার প্রকৃতি ছিল বিভিন্ন। তারা আল্লাহর কিতাব সাধারণ মানুষদের পড়তে দিত না, অনেক অবহেলা ও অযন্তে কিতাবের অনেক অংশ হারিয়ে ফেলে, অনেক কিছু পরিবর্তন করে এবং মনগড়া কথা রচনা করে তা দিয়ে মূল কিতাবের শিক্ষা ভুলিয়ে দেয়।

অন্যান্য আয়াত থেকে আমরা জানতে পারি যে, ধর্মীয় ভ্রাতৃত্বের অভাব, মতভেদকে শত্রুতার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, নিজের মতকে চূড়ান্ত সত্য মনে করে পরিতৃপ্ত ও আনন্দিত হওয়া ইত্যাদি ছিল পূর্ববর্তী উম্মাতদের ইফতিরাকের কারণ ও প্রকাশ। এক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন:

وَأَلْقَيْنَا بَيْنَهُمُ الْعَدَاوَةَ وَالْبَغْضَاءَ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ كُلَّمَا أَوْقَدُوا نَارًا لِلْحَرْبِ أَطْفَأَهَا اللَّهُ

‘‘তাদের মধ্যে আমি কিয়ামত পর্যন্ত স্থায়ী শত্রুতা ও বিদ্বেষ সঞ্চার করে দিয়েছি। যতবার তারা যুদ্ধের অগ্নি প্রজ্জ্বলিত করে ততবার আল্লাহ তা নির্বাপিত করেন।’’[2]

কুরআন কারীমে বারংবার বলা হয়েছে যে, ইফতিরাক ও দলাদলির কারণ অজ্ঞতা ছিল না, বরং জ্ঞান আসার পরেও জিদ, হিংসা, ঔদ্ধত্য, নিজ মত পরিত্যাগকে অপমান বলে গণ্য করা এবং সর্বোপরি ইখলাস ও তাকওয়ার অনুপস্থিতিই ছিল ইফতিরাক বা দলাদলির কারণ। মহান আল্লাহ বলেন:

وَمَا تَفَرَّقُوا إِلا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْعِلْمُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ

‘‘তাদের নিকট জ্ঞান আসার পর কেবলমাত্র পারস্পরিক বিদ্বেষবশত তারা নিজদের মধ্যে বিভেদ-দলাদলি করে।’’[3]

অন্য আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন:

وَإِنَّ هَذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاتَّقُونِ فَتَقَطَّعُوا أَمْرَهُمْ بَيْنَهُمْ زُبُرًا كُلُّ حِزْبٍ بِمَا لَدَيْهِمْ فَرِحُونَ

‘‘এবং তোমাদের এ জাতি একই জাতি এবং আমিই তোমাদের প্রতিপালক; অতএব আমাকে ভয় কর। কিন্তু তারা নিজদের মধ্যে তাদের দীনকে বহুধা বিভক্ত করেছে, প্রত্যেক দলই তাদের নিকট যা আছে তা নিয়ে আনন্দিত।’’[4]

আহলু কিতাবের বিভ্রান্তির অন্যতম কারণ অতিভক্তির কারণে ওহীর অতিরিক্ত মতামত উদ্ভাবন। এ বিষয়ে অন্যত্র মহান আল্লাহ বলেন:

يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ وَلا تَقُولُوا عَلَى اللَّهِ إِلا الْحَقَّ إِنَّمَا الْمَسِيحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ رَسُولُ اللَّهِ وَكَلِمَتُهُ أَلْقَاهَا إِلَى مَرْيَمَ وَرُوحٌ مِنْهُ فَآَمِنُوا بِاللَّهِ وَرُسُلِهِ وَلا تَقُولُوا ثَلاثَةٌ

‘‘হে কিতাবীগণ, দীনের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না এবং আল্লাহ্ সম্বন্ধে সত্য ব্যতীত বলো না। মরিয়ম তনয় ঈসা মাসীহ আল্লাহর রাসূল, এবং তাঁর বাণী, যা তিনি মরিয়মের নিকট প্রেরণ করেছিলেন এবং তাঁর থেকে (আগত) আত্মা (আদেশ)। সুতরাং তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলে উপর ঈমান আন এবং বলিও না ‘তিন’...।[5]

আমরা দেখেছি যে, খৃস্টানগণ ওহীর শব্দগুলির অতিভক্তিমূলক ব্যাখ্যা করে এরূপ ব্যাখ্যার উপর আকীদা বা ধর্মবিশ্বাসের ভিত্তি স্থাপন করে। খৃস্টধর্মের ইতিহাসের সাথে পরিচিত সকলেই জানেন যে, ঈসা (আঃ) কেন্দ্রিক বাড়াবাড়িই তাদের মধ্যকার সকল দলাদলি ও ফিরকাবাজির মূল বিষয় ছিল। ত্রিত্ববাদ নামক মনগড়া মতবাদ এবং ঈসা (আঃ)-এর প্রকৃতি ব্যাখ্যা নিয়েই তাদের যত ফিরকাবাজি।

বিশ্বাসের মধ্যে ওহীর সাথে ব্যাখ্যার নামে মানবীয় মতামত, দর্শন ইত্যাদি যোগ করে তাকে ধর্মে বা ধর্মবিশ্বাসে পরিণত করাকে কুরআন কারীমে ‘হাওয়া’ বা প্রবৃত্তির অনুসরণ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। ইহূদী-খৃস্টানগণের বিভ্রান্তি ও বিভক্তির আরেকটি দিক ছিল কতিপয় ‘পন্ডিতের’ প্রতি পরবর্তীদের অন্ধ ভক্তি ও তাদের মনগড়া মতামতের অন্ধ অনুকরণ। আল্লাহ বলেন:

قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لا تَغْلُوا فِي دِينِكُمْ غَيْرَ الْحَقِّ وَلا تَتَّبِعُوا أَهْوَاءَ قَوْمٍ قَدْ ضَلُّوا مِنْ قَبْلُ وَأَضَلُّوا كَثِيرًا وَضَلُّوا عَنْ سَوَاءِ السَّبِيلِ

‘‘বল, হে কিতাবীগণ, তোমরা তোমাদের দীনের বিষয়ে বাড়াবাড়ি করো না এবং যে সম্প্রদায় ইতোপূর্বে পথভ্রষ্ট হয়েছে ও অনেককে পথভ্রষ্ট করেছে এবং সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে তাদের ‘হাওয়া’ অর্থাৎ প্রবৃত্তি, মনগড়া মত বা খেয়াল-খুশির অনুসরণ করো না।’’[6]

[1] সূরা (৫) মায়িদা: ১৪-১৫ আয়াত।
[2] সূরা (৫) মায়িদা: ৬৪ আয়াত।
[3] সূরা (৪২) শূরা: ১৩ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (২) বাকারা ২১৩ আয়াত, সূরা (৩) আল-ইমরান: ১৯ আয়াত, সূরা (৪৫) জাসিয়াহ: ১৭ আয়াত।
[4] সূরা (২৩) মুমিনূন: ৫২-৫৩ আয়াত। আরো দেখুন: সূরা (৩০) রূম: ৩২ আয়াত।
[5] সূরা : ৪ নিসা, ১৭১ আয়াত।
[6] সূরা (৫) মায়িদা: ৭৭ আয়াত।